মননে কবে ফুটবে বসন্তের ফুল?

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৭ সময়ঃ ১:০১ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১:১১ অপরাহ্ণ

নাজমুল হক সুজন

01

অফিসে আসার জন্য সকাল সকাল বাসা থেকে বের হলাম। পাড়ার মুখেই দেখি দুই তরুণী হলুদ শাড়ি পরে, খোঁপায় ফুল গুঁজে রিকশা খুজছে। সচরাচর এমন দৃশ্য এই নগরে দেখা যায় না। তখনি মনে পড়লো আজ পহেলা ফাল্গুন, বসন্তের প্রথম দিন। মনে পরে গেলো কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত কবিতা-

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।

পাথরে পা ডুবানো এই নগরে এখন আর ফুল না ফোটার ভয় নেই। উন্নত বীজ, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদ, আরো নানান কায়দায় ফাল্গুন বা ভালবাসা’র দিনগুলোতে ফুলে ফুলে সয়লাব কাঠখোট্টা ঢাকা। তবে এই নগরীর অধিবাসীদের মননে কবে ফুল ফুটবে সেটা কেউই বলতে  পারবে না।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিদিন ১৭৭০ মানুষ যোগ হচ্ছে জীর্ণ ঢাকায়। নদী ভাঙন কিংবা মঙ্গা নয়, জীবিকার প্রয়োজনে আসছে তারা। আসছে কৈ মাছের ঝাঁকের মতন। কিন্তু যক্ষ্মা রোগীর মত জর্জরিত ঢাকা তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। কেউ জড়িয়ে পরছে অপরাধে, কেউ প্রতারণায়। যাদের কপাল ভালো সেই সব নারীরা যাচ্ছে গার্মেন্টসে। যাদের কপাল পোড়া তাদের ঠাই হচ্ছে কমলাপুর রেলস্টেশন কিংবা মতিঝিলের ফুটপাতে।

ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে রাজধানীতে হচ্ছে নানা আয়োজন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) সূত্রে জানা যায়, জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ ২২ বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও বসন্তের প্রথম দিনে বসন্ত বরণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় দিনব্যাপী এবং ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চ, লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুরশাহ পার্ক এবং উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণির উন্মুক্ত মঞ্চে বিকাল থেকে রাত অবধি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গানের দল সমগীত বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

এসবই সমাজের উপরতলার লোকদের জন্য। গরিবের জীবনে কোন বসন্ত নেই। তাদের প্রত্যেকটা দিনই সংগ্রামের। প্রত্যেকটা রাতেই তারা আশঙ্কা বুকে নিয়ে ঘুমাতে যায়- কাল ঠিকমতো খাবার জুটবে তো! তাইতো, ফার্মগেটে শাড়ি পাঞ্জাবি পরা তরুণ তরুণীর এক জটলা দেখে এক বাসের হেল্পার কে বলতে শুনলাম, আজকে কোন পূজা নাকি? উত্তরে তাঁর সহকর্মী জানালো, এদিকে মনে হয় কোন বিয়ে হচ্ছে। নিচতলার লোকদের কাছে বিয়ে, বসন্ত কিংবা উৎসবের খুব একটা ফারাক নেই।

02

চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে সুনীল যখন রাস উৎসব দেখতেন, তাঁর দিকে কঙ্ঙ্কন পরা ফর্সা রমণীরা তাঁর দিকে ফিরেও তাকাতো না। সে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি আজো। সামন্তবাদ বিদায় নিয়েছে সেই কবে; তবে আমরা সেই আদিকালের শ্রেণীবিভাগ, সেই উঁচুনিচু ভেদাভেদ, সেই ধনী-গরিব অহমিকা, সেই নষ্ট আভিজাত্য আজো জিইয়ে রেখেছি। মনের গহীন কোণে আজো অহংকার উঁকি দেয় আমাদের। মধ্যযুগীয় ‘ডিভাইন রাইট টু রুল’ আজো ভুলতে পারিনি আমরা।

পরিবর্তন যেটুকু হয়েছে আবহাওয়া আর পরিবেশের। কখন মাঘ এল, বাঘের গায়ে কখন শীত অনুভূত হল, কেউ টের পেল না। আমাদের চামড়া গণ্ডারের মত হয়ে গেছে। কারো দুঃখ, কারো কষ্ট আজ ঢাকাবাসীর গায়ে লাগে না। কাল কাঁচে ঢাকা তাপানুকুল গাড়িতে চড়তে পারলে আমরা ভাবি, আমারা বুঝি মোঘল সম্রাটের বংশধর। উটপাখির মত আমরা বালিতে মুখ গুঁজে থেকে ভাবি, কেউ বুঝি আমাদের দেখছে না। অথচ অই তাপানুকুল গাড়ির কাল কাঁচের বাইরের ফুটপাতে অর্ধাহারে অনাহারে যে কত মানুষ ধুকছে সে খবর কেইবা রাখি।

কুকুরের জন্মদিনের মতন আজকের বাসন্তী উৎসবেও লাখ লাখ টাকার খরচ হবে। টিএসসি বা রবীন্দ্র সরোবরে সেলফি উঠবে হাজারে হাজারে। বাসন্তী রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবীর জন্য ইতিমধ্যেই কেনাকাটা হয়ে গেছে। তবে ওই রাস্তার পাশের বৃদ্ধ ভিক্ষুক আবুল কালাম, আট বছর বয়সী লেগুনার হেল্পার রাকিব কিংবা আজো মলিন পোশাকে গার্মেন্টসে উপস্থিত হওয়া মরিয়মের খোঁজ কেউ কি নিবেন?

 

প্রতিক্ষণ/এডি/নাজমুল

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

April 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930  
20G